মতিহার বার্তা ডেস্ক :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ভবনের সামনে হাজারো শিক্ষার্থী শ্লোগানে মুখর। ডাকসু’র ভোট বর্জন করে তারা শ্লোগান দিচ্ছেন, ‘প্রহসনের নির্বাচন ছাত্রসমাজ মানে না। এসো ভাই, এসে বোন; গড়ে তুলি আন্দোলন, যে ভিসি ছাত্রলীগের সেই ভিসি চাই না’। অথচ সোমবার সূর্যোদয়ের সময়েও ঢাবিতে নতুন স্বপ্ন হাতছানি দিচ্ছিল। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। তাই শিক্ষার্থীরা ছিল নতুন স্বপ্নে বিভোর।
মানুষ যা ভাবে সবসময় তা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও হলো তাই। সোমবার ভোর থেকেই ঢাবি প্রাঙ্গন হয়ে উঠেছিল শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। কিন্তু ভোট শুরুর পর থেকেই কানে আসতে থাকে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার খবর।
কুয়েত-মৈত্রী হলে কয়েকটি ব্যালট বাক্স শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা করতে গেলে বাধা দেয় হলের প্রভোস্ট ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শবনম জাহান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা জোর করে বাক্স খুলে আগে থেকেই সিল মারা ব্যালট পেপার দেখতে পেলে আন্দোলন শুরু করে। বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শবনম জাহানকে বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীনকে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
অন্যদিকে বেগম রোকেয়া হলে একটি ট্রাংকে ব্যালট পেপার পায় শিক্ষার্থীরা। তখন উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা ভোট বর্জন ঘোষণা দিয়ে ওই হলের জন্য নির্ধারিত সকল ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয় বলে অভিযোগ করেন হলের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ফারহানা ফেরদৌসী। এ কারণে বেলা সোয়া বারোটা থেকে ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ও ডাকসুর ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুরু এ সময় ওই হলে গেলে তার উপর ছাত্রলীগ নেত্রীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়।
তবে এই ঘটনার প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর ভিপি প্রার্থী গোলাম রাব্বানি বলছেন, নুরু ব্যালট পেপার ছিনতাই করেছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া খেয়ে তিনি পালিয়েছেন। এখন অসুস্থ হওয়ার নাটক করছেন। যে ব্যালট পেপারগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো ফাঁকা ছিলো। তার বিরুদ্ধে মামলা করা হতে পারে।
এছাড়া সকাল থেকেই হাজী মোহাম্মদ মোহসীন হলসহ বিভিন্ন হলে অনিয়মের অভিযোগ আনতে থাকে ছাত্রলীগ ব্যাতীত সবকটি রাজনৈতিক ও স্বতন্ত্র প্যানেল। তারা প্রার্থীদেরও ভিতরে ঢুকতে না দেয়ার অভিযোগ আনেন। এছাড়া নির্বাচনে জাল ভোট দেয়া হচ্ছে বলেও জানান সবাই। একজোট হয়ে সবাই অভিযোগ করেন, ভিসি প্রশাসন ছাত্রলীগকে জয়ী করার জন্যই এমন করছে।
সময় যত গড়াতে থাকে ততই উত্তপ্ত হতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। দুপুর ১টা থেকে প্রথমে বাম জোট এবং পরবর্তীতে ছাত্রদল, কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ একে একে সবাই কারচুপি, জালভোট, প্রশাসনের অসহায়তার অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করে। একইসাথে পুণঃতফসিলের দাবি জানান। সেইসাথে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটের ডাক দেন তারা।
ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডাকসু নির্বাচনের কোনো সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। প্রশাসন শুরু থেকেই ভোট কারচুপিতে যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন হল থেকে সিল মারা ব্যালট পেপার উদ্ধার করা হয়েছে। এভাবে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। আমরা এ নির্বাচন বর্জন করছি।
বাম জোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী বলেন, ভোটে অনিয়ম, কারচুপি, জালভোট ও ছাত্রলীগের অধিপত্য সর্বত্র। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি ‘ঘৃণা’ জানিয়ে এই ভোট বর্জন করে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি আমরা।
পরে এসব দাবি নিয়ে ভিসি ভবনে অবস্থান নিতে যান প্রার্থীরা। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও পৃথক বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ভিসি ভবনে অবস্থান নিতে যান। সেখানে ভিসিকে না পেয়ে মিছিল নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে ভিসির বাসভবনের সামনে এসে অবস্থান নেন ছাত্রনেতারা।
তবে ছাত্রলীগ পুণঃনির্বাচনের দাবিকে হাস্যকর দাবি করে এর সভাপতি ও ডাকসু ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, তারা নির্বাচনে হারার বিষয়টি আচ করতে পেরেই এই নাটক করছে। নুরু-লিটনদের এটা পূর্বপরিকল্পিত বলেও জানান তিনি।
দুপুর ২টা থেকে নির্বাচন বর্জনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আক্তারুজ্জামানের বাসভবনের সামনে জড়ো হতে থাকে। তারা এই নির্বাচনকে প্রত্যাক্ষাণ করে ফলাফল বাতিল ও নতুনকরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দাবিতে অবস্থান নেয়। ভিসি চত্বর এখন ভোট বর্জনকারীদের শ্লোগানে উত্তাল।
নতুন করে ভোট গ্রহণ বা ভোট বাতিলের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেন, কুয়েত-মৈত্রি হলে এবং বেগম রোকেয়া হলে কিছু অনিয়ম হয়েছে। আমরা তাৎক্ষনিক সেখানে ব্যবস্থা নিয়েছি। আর রোকেয়া হলের ঘটনাকে তেমন অনিয়ম বলা যায় না। তার পরেও আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এই নির্বাচনকে বাতিল করা হবে না বলেও জানান তিনি। আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, তারা আন্দোলন করছে কিন্তু আমার মনে হয় ফলাফল বাতিলের মত তেমন কিছু ঘটেনি।
অন্যদিকে নির্বাচন সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর হয়েছে বলে দাবি করেছেন ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।
প্রসঙ্গত ২৮ বছর পর অনুষ্ঠেয় ডাকসু নির্বাচন শুরু হয় সকাল ৮টায়। বেলা ২টা পর্যন্ত চলে ভোটগ্রহণ। এতে ৪৩ হাজার ২৫৬ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। মোট ভোটারের মধ্যে ছাত্র ২৬ হাজার ৯৪৪ এবং ছাত্রী ১৬ হাজার ৩১২ জন।
ডাকসুতে ২৫ পদে নির্বাচন হচ্ছে। বিভিন্ন পদের মধ্যে আছে ভিপি, জিএস, এজিএস একটি করে ৩টি। আরও আছে- সম্পাদকীয় ৯টি এবং ১৩টি সদস্যপদ। এসব পদের জন্য বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্রসহ প্রার্থী ২২৯ জন। তাদের মধ্যে স্বতন্ত্রসহ ভিপি ২১, জিএস ১৪ জন।
ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ১৩টি প্যানেল। অন্যদিকে প্রত্যেক হল সংসদে ১৩টি পদে নির্বাচন হচ্ছে। এর মধ্যে ভিপি, জিএস, এজিএস একটি করে তিনটি। আরও আছে সম্পাদকীয় ৬, সদস্য ৪টি। হল সংসদ (১৮টি হল, ২৩৪ পদে) প্রার্থী ৫০৯ জন। হল সংসদ ও ডাকসু মিলিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে গড়ে ৩৮টি করে ভোট দিতে হয়। সুষ্ঠুভাবে ভোটের কাজ শেষ করতে রিটার্নিং অফিসারসহ (আরও) ৪২ জন কাজ করেন।
মতিহার বার্তা ডট কম ১১ মার্চ ২০১৯
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.